এম সাখাওয়াত হোসেন
মিয়ানমারের (পুরাতন বার্মা) রাখাইন অঞ্চলে (পূর্বতন আরাকান রাজ্য) প্রায় এক দশক পর পুনরায় জাতিগত ও ধর্মীয় বিভেদে দাঙ্গা শুরু হয়েছে। এরই প্রেক্ষাপটে রাখাইন রাজ্যের সঙ্গে লাগোয়া একমাত্র রাষ্ট্র বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পুনরায় শরণার্থীরা প্রবেশের চেষ্টা চালিয়েছে। এবার আগাম সতর্কতা নেওয়াতে এখন পর্যন্ত রাখাইন অধিবাসী সংখ্যালঘু মুসলমান, যারা রোহিঙ্গা বলে পরিচিত_ বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারেনি। তবে এই তৎপরতায় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কতদিন ঠেকানো যাবে তা নিয়ে শঙ্কা থেকেই যায়। এর প্রথম কারণ জাতিসংঘের সংস্থা ইউএনএইচসিআরের (টঘঐঈজ) উপর্যুপরি চাপ, বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার সংগঠনের তৎপরতা এবং আমাদের সংবিধানের চেতনা, যার পরিপ্রেক্ষিতে আশ্রয় প্রার্থনাকারী নিরাশ্রয় জনগোষ্ঠীকে ফিরিয়ে দেওয়া যায় না। অতীতেও রোহিঙ্গা শরণার্থী নিয়ে বিপাকে পড়েছে বাংলাদেশ। ১৯৭৮-৭৯ সালে সামরিক শাসনকালে জান্তা সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধদের অবস্থান শক্ত করতে রাখাইন অঞ্চলে 'এথনিং ক্লিনসিং'-এর আদলে দাঙ্গা উস্কিয়ে দেয়। ওই দাঙ্গা থেকে প্রাণ বাঁচাতে প্রায় এক লাখের মতো শরণার্থী বাংলাদেশে প্রবেশ করে। পরে অনেকে ফিরে গেলেও আনুমানিক ২০ থেকে ৫০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী চট্টগ্রাম, কক্সবাজার জেলার দক্ষিণের উপজেলাগুলোতে, পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় অবৈধভাবে থেকে যায়। তাদের অনেকেই এসব স্থানে জায়গা-জমি ক্রয় করে স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। এখানেই ক্ষান্ত হয়নি। পরে তাদের সূত্রেই অরক্ষিত মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্ত ধরে আরও হাজার হাজার রোহিঙ্গা মিয়ানমারের রাখাইন অঞ্চল ছেড়ে বাংলাদেশের এসব অঞ্চলে বসবাস শুরু করে। এমনকি ১৯৮০-র দশকে পর্যায়ক্রমে তাদের নাম ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হলে বাংলাদেশি নাগরিক হওয়ার প্রামাণিক দলিল হাতে পায়। এসব অবৈধ অনুপ্রবেশকারীর ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তির পেছনে স্থানীয় রাজনীতিবিদরা উদ্যোক্তা হয়ে নিজেদের ভোটব্যাংক বাড়াতে এমন গর্হিত কাজ করেছেন এবং পরে যতবার ভোটার তালিকা তৈরি হয়েছে ততবার এসব অঞ্চলে ভোটার সংখ্যা বেড়েছে। ব্যতিক্রম ছিল ২০০৭-০৮ সালের ছবিসহ ভোটার তালিকা। কিন্তু ২০০৯ সালে তালিকা হালনাগাদ করতে গিয়ে রোহিঙ্গা অন্তর্ভুক্তি করার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় নির্বাচন কমিশন বিশেষ ব্যবস্থায় স্ক্রিনিং করে ৪০ থেকে ৪৫ হাজার রোহিঙ্গা বা বহিরাগতকে ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেয়। এ সময়ও তাদের অন্যায়ভাবে ভোটার হতে সহযোগিতা করেন স্থানীয় থেকে জাতীয় পর্যায়ের স্থানীয় রাজনীতিবিদরা। রোহিঙ্গাদের নিয়ে এ ধরনের রাজনীতি এখনও বন্ধ হয়নি, যে কারণে শত শত রোহিঙ্গা বাংলাদেশি পাসপোর্টে মধ্যপ্রাচ্য, বিশেষ করে সৌদি আরবে চাকরি সূত্রে এ দেশের শ্রমিক কোটায় গিয়ে নানা অপকর্মে জড়িত হয়ে পড়ছে। এতে বাংলাদেশের মর্যাদাহানি হয়েছে, এখনও হচ্ছে। ইদানীং এই প্রবণতা সৌদি আরবের ক্ষেত্রে বেশি দেখা যায়।
আরাকান থেকে স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীর বাংলাদেশে আগমন ও উদ্বাস্তু হিসেবে স্বীকৃত হয়ে ইউএনএইচসিআরের তত্ত্বাবধানে কক্সবাজারের দুটি প্রধান শিবিরে, ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ সীমান্তে ঘটে যাওয়া ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এবং পরে সমগ্র রাখাইন অঞ্চলে ব্যাপক দাঙ্গার কারণে আশ্রয় নেয়। ওই সময়ে ধারণা করা হয় যে, প্রায় এক লাখ শরণার্থী বাংলাদেশে ১৯৯২ সালের প্রথম দু'মাসে প্রবেশ করে। বর্তমান পরিসংখ্যানে প্রতীয়মান হয় যে, উলি্লখিত দুটি শিবিরে মাত্র ২০ হাজার শরণার্থী রয়েছে। বাকি রোহিঙ্গারা ধর্ম, ভাষাগত এবং সামাজিক নৈকট্যের কারণে শিবির ছেড়ে ওই অঞ্চলের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসবাস করছে। অনেক স্থানীয় বিত্তশালী রাজনৈতিক মদদপুষ্ট হয়ে চিংড়ি ঘের, লবণ চাষ এবং অন্যান্য কাজে স্বল্প পরিশ্রমে তাদের নিয়োজিত করে ভোটার তালিকা এবং জাতীয় পরিচয়পত্র প্রাপ্তিতে পূর্ণ সহযোগিতা করেন। এই বৃহৎ উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠী বিগত তিন দশকেও নিজেদের জন্মস্থানে ফিরে যেতে পারেনি। কারণ শত শত বর্ষপূর্ব থেকে বাসিন্দা হয়ে থাকলেও মিয়ানমার সরকার, বিশেষ করে সামরিক জান্তা রাখাইন বা আরাকান অঞ্চলের এই বাসিন্দাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। ২০০৯ সালের জাতিসংঘের হিসাবে, বর্তমানে রাষ্ট্র দ্বারা স্বীকৃত নয় এমন হতভাগ্য রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মোট জনসংখ্যা ৭ লাখ ২৯ হাজার, যার মধ্যে বর্তমানে প্রায় এক থেকে দেড় লাখ জন্মভূমি ছাড়া শরণার্থী হয়ে রয়েছে।
মিয়ানমার সরকার এবং ওই দেশের ঐতিহাসিকদের মতে, ১৮২৪ সালের পূর্বে রোহিঙ্গা নামের মুসলিম জনগোষ্ঠীর এতদঞ্চলে কোনো অস্তিত্ব ছিল না। মিয়ানমার তথা বার্মার অপর ঐতিহাসিক খিন মং সর (কযরহ গধঁহম ঝধ)ি মতে, রোহিঙ্গাদের আগমন ঘটে ১৯৫০ সালের পর থেকে এবং তাদের আদি বাস তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে। তার মতে, 'এর মানে এই নয় যে, এতদঞ্চলে মুসলমানরা ছিল না।' অষ্টম ও নবম শতাব্দীতে যেসব আরব এবং অন্য মুসলমানরা তৎকালীন বার্মায় এসেছিল তারা আরাকানে নয়, বার্মার অন্যান্য স্থানে বসতি স্থাপন করেছিল। অথচ ১৮৯১ সালে ব্রিটিশ আদমশুমারিতে আরাকানে ৫৮ হাজার ২৫৫ জন রোহিঙ্গার অস্তিত্ব পাওয়া যায়, যা ১৯১১ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছিল এক লাখ ৭৮ হাজার ৬৪৭ জনে। এই পরিসংখ্যান ছিল একশ' বছর পূর্বের।
ঐতিহাসিকভাবে আরাকান কখনোই বার্মার অংশ ছিল না। আরাকান আলাদা রাষ্ট্র ছিল এবং বর্তমান চট্টগ্রাম অঞ্চল আরাকান রাজ্যের অংশ ছিল, যা ১৬৬৬ সালে মোগলরা দিলি্লর শাসনে অন্তর্ভুক্ত করে। আরও পরে আরাকান রাজ্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অন্তর্ভুক্ত হলে উনিশ শতকের শুরু থেকেই ভারত থেকে, বিশেষ করে পূর্ব ভারত থেকে চাষাবাদ এবং অন্যান্য কাজের জন্য বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে এতদঞ্চলে নিয়ে আসা হয়েছিল। এ ইতিহাস মিয়ানমারের সামরিক জান্তা অদ্যাবধি অস্বীকার করে আসছে। তাদের মতে, ১৮২৪ সালের প্রথম অ্যাংলো-বার্মা যুদ্ধের সময়ই নাগরিকত্বের বেসলাইন।
যাই হোক, আমি বর্তমানে রাখাইন রাজ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রেক্ষাপটে এতটা ইতিহাস বর্ণনা করলাম এ কারণে যে, ১৯৬২ সালে মিয়ানমারে সামরিক জান্তা ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে এ অঞ্চলে অন্যান্য অঞ্চলের মতো ইনসারজেন্সির জন্ম নেয়। রোহিঙ্গারাও জড়িয়ে পড়ে তাদের অধিকার আদায়ের লড়াইতে। ওই অঞ্চলের রোহিঙ্গারা সামরিক জান্তাবিরোধী হওয়ার পর থেকে ঘন ঘন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার শিকার হতে থাকে, যদিও এ ধরনের দাঙ্গা ব্রিটিশ শাসনামলেও হয়েছিল। বিগত শতাব্দীর সত্তর দশকের শেষ দিক থেকে তথাকথিত আরাকান মুসলমানদের অনেককে আফগান যুদ্ধে সম্পৃক্ত করা হয়। বিশেষ করে ওই সময় বাংলাদেশস্থিত রোহিঙ্গাদের মধ্যপ্রাচ্যের, বিশেষ করে সৌদি আরবের অর্থায়নের মাধ্যমে সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধে অংশগ্রহণে উৎসাহিত করে হরকাতুল জিহাদ নামক সংগঠন গড়ে তোলা হয়, যা এখন জঙ্গি সংগঠন হুজি (বি) নামে নিষিদ্ধ রয়েছে। আফগান যুদ্ধফেরত রোহিঙ্গারা গড়ে তোলে একাধিক জঙ্গি সংগঠন, যারা রাখাইন অঞ্চলে নিজেদের দাবি আদায়ে সশস্ত্র সংগ্রামের সূচনা করে। তবে তাদের সংগঠন মিয়ানমারে ওই সময় অন্যান্য অঞ্চলভিত্তিক ইনসারজেন্ট সংগঠনগুলোর মতো সংগঠিত এবং শক্তিশালী ছিল না। রোহিঙ্গাদের একাধিক সংগঠনের মধ্যে আরএসও (জঝঙ) এবং আরাকান লিবারেশন ফ্রন্ট (অখঋ), আরাকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন (অজঘঙ) জাতীয় কয়েকটি সংগঠন তৎপর ছিল। তাদের বেশিরভাগের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতো বাংলাদেশ সীমান্ত অঞ্চল থেকে। তাদের অনেক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি বহু বছর পূর্ব থেকেই কক্সবাজার অঞ্চলে ঘাঁটি গেড়েছিল।
ওই সময় এবং আরও পরে এসব সংগঠনের সঙ্গে বিদেশের কিছু সংগঠন জড়িত হয়ে পড়ে। এমনই পরিস্থিতিতে ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরের শেষ দিকে বাংলাদেশের তৎকালীন বাংলাদেশ রাইফেলসের সীমান্ত চৌকি রেজুপাড়াতে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী নাসাকা বাহিনী অতর্কিত হামলা চালায় এবং কয়েকটি অস্ত্র লুট করে নিয়ে গিয়েছিল। মিয়ানমারের অভিযোগ ছিল, তৎকালীন বিডিআরের সহযোগিতায় রোহিঙ্গা জঙ্গি সংগঠন নাসাকা বাহিনীর ওপর হামলা চালিয়েছিল। যার পরিপ্রেক্ষিতে প্রথমে তৎকালীন বিডিআরের ওপর হামলা এবং পরে নাসাকা বাহিনীর মদদপুষ্ট হয়ে রাখাইন অঞ্চলে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটে। ওই ঘটনার পরপরই সীমান্তে বাংলাদেশের তরফ থেকে সেনা মোতায়েন করা হয়। আমার মনে হয়, স্বাধীন বাংলাদেশে ওই প্রথম একটি প্রতিবেশী দেশের বিরুদ্ধে সীমান্তে এত বৃহৎ আকারে সামরিক বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছিল। শুধু সেনাবাহিনীই নয়, মোতায়েন হয়েছিল তিন বাহিনী। ব্রিগেড অধিনায়ক হিসেবে আমি ওই বাহিনীর কমান্ডে প্রায় এক মাস যুদ্ধাবস্থায় কাটিয়েছিলাম। পরে সীমান্ত থেকে সেনা অপসারণের পরপরই রাখাইন অঞ্চল থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থীর ব্যাপক আগমন ঘটে। ওই সময়কার শরণার্থীরা এখনও কক্সবাজারের দুটি শরণার্থী শিবিরে রয়ে গেছে। এসব শরণার্থীকে ফেরত পাঠানোর কোনো উদ্যোগই কার্যকর করতে পারেনি ইউএনএইচসিআর।
১৯৭৮ থেকে ১৯৯১ সালে রোহিঙ্গাদের নিয়ে যে ধরনের আন্তর্জাতিক কূটনীতি চলছিল তা সে সময়ের মিয়ানমার সরকারের ওপর পূর্বদিক থেকেও ইনসারজেন্সির মাধ্যমে চাপ সৃষ্টি করার প্রয়াস বলে আমার মনে হয়েছিল। প্রায় সব ক'টি রোহিঙ্গা জঙ্গিগোষ্ঠীর নেতাদের অবস্থান কক্সবাজার অঞ্চল হওয়ায় মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক তেমন ভালো ছিল না। এখনও তেমন ভালো হয়েছে বলে মনে হয় না। এক সময়ের আমাদের 'পূর্ব নীতি' মুখ থুবড়ে পড়েছে, কারণ রোহিঙ্গা সমস্যার সম্মানজনক সমাধানের অভাবে। মিয়ানমারের পরিবর্তিত অভ্যন্তরীণ নীতির কারণে পশ্চিমা বিশ্বে এখন মিয়ানমারকে নিয়ে এক ধরনের সুখকর অবস্থান তৈরি হয়ে থাকলেও মিয়ানমারে প্রকৃত গণতন্ত্র এখনও সুদূরপরাহত বলে মনে হয়। গণতন্ত্রের মানসকন্যা বলে পরিচিত অং সাং সু চি বর্তমানের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নিয়ে কোনো বক্তব্যই দেননি, অথচ দাঙ্গা শুরু হওয়ার পরপরই ইয়াঙ্গুনে মুসলিম নেতারা তার সঙ্গে দেখা করেছিলেন। সু চি ওই নেতাদের আশ্বাসও দিয়েছিলেন। তার দেশের অত্যন্ত ক্ষুদ্র সংখ্যালঘুদের বছরের পর বছর নিগৃহীত হওয়ার ইতিহাস এবং এই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা পেছনে ফেলে সু চি ইউরোপ ভ্রমণে পা বাড়িয়েছেন। এতগুলো বছর সামরিক জান্তার বিরোধিতা করা এই জনগোষ্ঠী স্বভাবতই সু চির এই নিষ্ক্রিয়তায় হতাশ হয়েছে।
আরাকান বা রাখাইন অঞ্চল প্রায় চৌদ্দ হাজার বর্গকিলোমিটারের ভূখণ্ড, যেখানে রয়েছে প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার উত্তর-দক্ষিণ বঙ্গোপসাগর সমুদ্র তট এবং গ্রেট কোকোসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দ্বীপ। শুধু অর্থনৈতিক দিক থেকেই নয়, বর্তমান বিশ্ব ভূরাজনৈতিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। মূলত এই অঞ্চল ঘিরেই চীন-ভারত-মার্কিন টানাপড়েন চলেছে বহুদিন। চীন বিগত চার দশক অর্থনৈতিক এবং ভূরাজনৈতিক অঙ্গনে মিয়ানমারের সঙ্গে যে সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল তারই প্রেক্ষাপটে বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিয়ানমার নিয়ে এত উচ্ছ্বাস। চীনের কাছে রাখাইন অঞ্চল অধিক গুরুত্বপূর্ণ। চীনের ২.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচে যে তেল ও গ্যাসের পাইপলাইন এবং সমান্তরাল রেললাইনের কাজ চলছে তার পূর্ব টার্মিনাল রাখাইন তটে। রাখাইন তটের নতুন নৌবন্দর কিউকপিউ (শুধশঢ়যু)ি থেকে চীনের তেল এবং গ্যাস পাইপলাইন রুলি হয়ে ইউনান প্রদেশ পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়েছে। মিয়ানমারের ওই অঞ্চলের 'শ' (ংধ)ি গ্যাসক্ষেত্র থেকে চীনের কুনমিং হয়ে ইউনান প্রদেশে সঞ্চালিত হবে। অন্যদিকে চীনের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের জন্য উত্তর আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের তেল একই পথে কিউকপিউ-রুলি কুনমিং-ইউনান পাইপলাইনের মাধ্যমে সঞ্চালিত হওয়ার কথা। আলোচিত এই চীনা টার্মিনালের দক্ষিণে রয়েছে ভারতে আন্দামান-নিকোবর নৌস্থাপনা। রয়েছে ভারতের ইলেকট্রনিক পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা, তেমনি আন্দামান-নিকোবরের উত্তরে মিয়ানমারের গ্রেট কোকো দ্বীপ চীনাদের প্রভাবে রয়েছে। প্রাপ্ত সূত্র মতে, কোকো দ্বীপে রয়েছে চীনের ইলেকট্রনিক পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র। এই ভূকৌশলগত অবস্থানের কারণে এ অঞ্চলে চীন-ভারত এবং হালে মার্কিন টানাপড়েন অতীতের যে কোনো সময় থেকে বেড়েছে।
ওপরের বিশ্লেষণের আঙ্গিকে এবং মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ওপর চীনের গভীর প্রভাব থাকাতে সামরিক বাহিনীর মধ্যে বর্তমানে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার অত্যধিক উদারনীতি নিয়ে বিভেদ রয়েছে বলে বিশ্লেষকদের ধারণা। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, বর্তমান জান্তাপ্রধান রাষ্ট্রপতি থানসিনের উদার নীতির সামরিক বাহিনীর মধ্যে বহু বিরোধী রয়েছে। কাজেই মিয়ানমারের এবং ভূরাজনৈতিক কারণে অত্যন্ত সংবেদনশীল এ অঞ্চলে হঠাৎ করে এই রোহিঙ্গা সমস্যা থানসিন এবং সু চির জন্য বিব্রতকর প্রমাণিত হতে পারে। যাই হোক, বর্তমানে রাখাইন অঞ্চল হঠাৎ করে এ ধরনের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রেক্ষাপটে একদিকে বলি হচ্ছে হতভাগ্য রোহিঙ্গারা, অন্যদিকে এর মাশুল গুনতে হচ্ছে বাংলাদেশের মতো একটি দুর্বল দেশকে। ইতিপূর্বের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রায় এক লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে মাত্র ৪০ হাজার ইউএনএইচসিআরের তথাকথিত তত্ত্বাবধানে রয়েছে। আর বাকিদের হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। এর কিছু কারণ প্রথমেই উল্লেখ করেছি। এবারও বাংলাদেশকে চাপ সইতে হবে। ইতিমধ্যেই জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের গ্রহণ করার জন্য সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করছে। অতীতেও ইউএন বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের জন্য মিয়ানমার সরকারকে যথেষ্ট চাপ দেয়নি, এখনও দেবে কি-না সন্দেহ রয়েছে। পশ্চিমা বিশ্ব এখন মিয়ানমারকে মাথায় তুলে ধরার চেষ্টা করছে। কিন্তু এই অমানবিক কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে তাদের তরফ থেকে তেমন শক্ত পদক্ষেপের কোনো লক্ষণ এখন পর্যন্ত দেখা যায়নি। মিয়ানমারের ওপর থেকে যুক্তরাষ্ট্রসহ সব ইউরোপীয় দেশও প্রায় তিন দশকের পুরনো নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়ে মিয়ানমার সরকারকে অর্থনৈতিক লগি্নর আশ্বাস দিচ্ছে। সেই শক্তিগুলো মিয়ানমার সরকারকে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে 'রাষ্ট্রহীন জনগোষ্ঠী' হিসেবে আখ্যায়িত না করে নাগরিক হিসেবে গ্রহণ করার জন্য চাপ প্রয়োগ করতে পারে; কিন্তু তেমন উদ্যোগ এখনও দেখা যায়নি। অথচ মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে মধ্যপ্রাচ্যে চলছে রিজিম চেঞ্জের মহড়া।
ওপরের বিশ্লেষণের আলোকে আমি মনে করি, অতীতের মতো এবারও রাখাইন অঞ্চলের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পরিপ্রেক্ষিতে উদ্ভাবিত পরিস্থিতির শিকার হতে হবে আমাদের। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিক্রিয়া যথার্থ হলেও যথেষ্ট নয়। মিয়ানমার সম্বন্ধে আমরা অতীতেও উদাসীন ছিলাম, এখনও রয়েছি। ইয়াঙ্গুনের পূর্বতন পরিস্থিতি বদলানোর পরপরই নিকটতম প্রতিবেশী হিসেবে আমাদের সম্পর্ক এখনই উন্নত করার সময় ছিল, যার উদ্যোগ আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিয়েছে বলে মনে হয় না। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের সরকারপ্রধানরা ইয়াঙ্গুনে সফরে এসেছেন, এমনকি হালে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর হাই প্রোফাইল ইয়াঙ্গুন সফরের পরও আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে মিয়ানমার সফরের তেমন উদ্যোগ দেখা যায়নি। অথচ মিয়ানমারের অভ্যন্তরে বিগত বছরগুলোতে ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কুফল দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র বাংলাদেশকেই বহন করতে হয়েছে। তারপরও আমরা মিয়ানমারের সঙ্গে শীর্ষ পর্যায়ে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা সমাধানের পথ তেমনভাবে খুঁজিনি।
আমি এখনও মনে করি, এই সমস্যা সমাধান এবং আরও ভালো সম্পর্ক গড়ে তোলার লক্ষ্যে বাংলাদেশ থেকে শীর্ষ পর্যায়ে ইয়াঙ্গুন সফরে যাওয়া উচিত। একইভাবে রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির বিষয়ে পশ্চিমা বিশ্ব তথা জাতিসংঘের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে আমাদের সরকারের তৎপরতা জোরদার করতে হবে। এখনও আমরা সে ধরনের কোনো উদ্যোগ দেখছি না। রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে অতীতের মতো এবারও আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিক্রিয়া জবধপঃরাব, চৎড়-ধপঃরাব নয়। 'রোহিঙ্গারা' যাতে নিজ জন্মভূমিতে 'নাগরিক' হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে অধিকার নিয়ে বসবাস করতে পারে সে ধরনের ব্যবস্থা নিতে আন্তর্জাতিক মহলকে বাংলাদেশের চাপ দেওয়া উচিত। অন্যথায় ভবিষ্যতেও এ ধরনের পরিস্থিতি শিকার আমাদের হতে হবে।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন :সাবেক নির্বাচন কমিশনার, কলাম লেখক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
যযরহঃষনফ@ুধযড়ড়.পড়স
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন